উজরা জেয়ার সঙ্গে ও পরবর্তী ভিসানীতি কার্যকরের ঘোষণা 

উজরা জেয়ার সঙ্গে ও পরবর্তী ভিসানীতি কার্যকরের ঘোষণা 

২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সময় দুপুর তিনটার পরে উজরা জেয়ার সঙ্গে বৈঠকের খবর প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারসংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারির দুটি প্রধান বিষয়ে আলাপ হয়েছে। একটি হলো রোহিঙ্গা সমস্যা ও আরেকটি হলো আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা। বৈঠকের ঘন্টা দুয়েক পরে বাংলাদেশের মিডিয়ার খবরে ভেসে আসে যে সংবাদ তাহলো- মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ঘোষণা। বুঝতে সমস্যা হয় না, ঘোষিতভাবে এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন ভিসা নীতির ধারাবাহিকতারই অংশ। বলা হয়, এই নীতি মূলত প্রযোজ্য হবে গণতান্ত্রিক এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ওপর। এরপরে যে প্রশ্নটি সামনে আসে- তবে কী উজরা জায়ার সঙ্গে বৈঠকে এমন কিছু ঘটেছে যা ভিসানীতি কার্যকরের ঘোষণা ত্বরান্বিত করেছে। 

প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনায় বসলে সবার আগে যেটি সামনে আসে তাহলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইজরা জেয়ার আবদার ও বাংলোদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যৌক্তিক অবস্থান। আবদারটি কী ছিলো? আবদার হলো, তিনি বলছেন বৈঠকে তাঁরা রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জন্য ১১৬ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু তিনি পাশাপাশি এও বলছেন, রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবিকা নিশ্চিত করতে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির করতে হবে। এবং পাশাপাশি পাদটীকা হিসেবে যুক্ত করছেন যে, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো শুরু করার আগে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে জাতিসংঘ সদর দফতরের দ্বিপাক্ষিক কক্ষে ২০ মিনিটের এ বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট ও নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে উজরা জেয়া জানান, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পরিস্থিতি এখনও প্রস্তুত নয়। 

আচ্ছা, উজরা জেয়ার যদি মনে হয়, নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পরিস্থিতি প্রস্তুত নয়, সেক্ষেত্রে এককভাবে বাংলাদেশের করণীয় কি? রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা? একটা দেশে বিশেষ পরিস্থিতিতে যে রিফ্যুজি জনগোষ্ঠীকে জায়গা দেওয়া হলো, সাত বছর ধরে তাদের ভালোভাবে টিকে থাকার ব্যবস্থাদি দেখভাল করা হলো, তাদের একার দায়িত্ব সেই জনগোষ্ঠীকে ‘অ্যাবজর্ব’ করে নেওয়া? বাংলাদেশের জন্য সেটা হুমকিরা কিনা, নিরাপত্তাহীনতা আছে কিনা সেসব বিবেচনায় নিবে কে?

জেয়ার সাথে ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করা।’ 
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বরাবরই বলছেন, যদি প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হয় তবে এ অঞ্চল নিরাপত্তা–হুমকির মধ্যে পড়বে। কারণ, রোহিঙ্গারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। যার মধ্যে রয়েছে হত্যা, আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান ও মাদক ব্যবসা। রোহিঙ্গারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। 
এর আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনের ফাঁকে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ, কানাডা, গাম্বিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সদর দপ্তরে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ‘তারা কি আমাদের ভুলে গেছে?’ শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের এক ইভেন্ট  আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা কমছে, অন্যদিকে তাদের প্রত্যাবাসনে ধীরগতিতে বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গা সংকটের একটি টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বানও জানান তিনি। বাংলাদেশের এই অবস্থানের জন্য কি তাকে চাপে ফেলা যায়? আশ্রয় দিয়ে এতো মানুষের জীবন বাঁচিয়ে বিশ্বমোড়লদের কাছ থেকে এই পরামর্শ কীভাবে মোকাবিলা করবে বাংলাদেশ।

২২ সেপ্টেম্বর জেয়ার সঙ্গে বৈঠকে আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে যেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অংশ না নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধীরা দেশে অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। কিন্তু অশান্তি সৃষ্টি না করে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সবার সহযোগিতা জরুরি। এবং প্রধানমন্ত্রী সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলেও দৃঢ়তা দেখান। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক এই আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। 

এরপরপরই ভিসানীতি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ঘোষণা আসে। দুটো ঘটনার ধারাবাহিকতায় প্রশ্ন তৈরী হয় এই ভিসানীতি সরকারকে প্রত্যক্ষ চাপে ফেলার কৌশল হিসেবে ছিলো কিনা। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আভ্যন্তরীণ দুই ইস্যুকে ধরে নিষেধাজ্ঞার আওতায় ফেলার প্রতিক্রিয়াও সেকারণে ছিলো বেশ কড়া। ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশও জানে কীভাবে নিষেধাজ্ঞা দিতে হয়, ওরা হয়তো তা জানেন না। তাই আগামী নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হলে বাংলাদেশের জনগণও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। আমরা দেখতে চাই, দেশের বাইরে থেকেও যেন কোনো চেষ্টা না হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে শুক্রবার বিকেলে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। 

ফলে সেখানে বলা প্রধানমন্ত্রীর কয়েকটি বাক্য স্মরণ রাখা খুব জরুরি। শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে এখন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের কোনো সুযোগ নেই। আইন লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও সংবিধান লঙ্ঘন করে কেউ যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এটি ভুলে গেলে চলবে না। শুধু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া অন্য কেউ বিকল্প উপায়ে ক্ষমতায় আসতে চাইলে তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।